শিশুর খিঁচুনি (Seizure) একটি জটিল সমস্যা, যা অভিভাবক ও চিকিৎসক—উভয়ের জন্যই দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত স্নায়বিক সমস্যার কারণে খিঁচুনি হয়ে থাকে, তবে হরমোনের অসামঞ্জস্যতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে। হরমোন রক্তের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম ও গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। তাই হরমোনের তারতম্য ঘটলে শিশুর খিঁচুনির ঝুঁকি বেড়ে যায়।
হরমোনজনিত খিঁচুনির কারণ
অ্যাড্রেনাল হরমোনের অসামঞ্জস্যতা:
- অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি কর্টিসল ও অ্যালডোস্টেরন নামক হরমোন নিঃসরণ করে, যা শরীরে সোডিয়াম ও গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
- কর্টিসলের ঘাটতি হলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে শর্করার মাত্রা কমে যাওয়া) হতে পারে, যা খিঁচুনির কারণ হতে পারে।
- অতিরিক্ত অ্যালডোস্টেরন শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা খিঁচুনির সৃষ্টি করতে পারে।
পিটুইটারি গ্রন্থির হরমোনের তারতম্য:
- পিটুইটারির হরমোন ভ্যাসোপ্রেসিন কমে গেলে রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায় এবং ডিহাইড্রেশন দেখা দেয়, যা খিঁচুনির কারণ হতে পারে।
- আবার ভ্যাসোপ্রেসিন ওষুধের মাধ্যমে গ্রহণ করলে সোডিয়ামের মাত্রা কমে যেতে পারে, যা খিঁচুনি সৃষ্টি করতে পারে।
ইনসুলিন ও গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা:
- প্যানক্রিয়াস থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন ও গ্লুকাগন হরমোন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
- রক্তে শর্করার মাত্রা অতিরিক্ত কমে গেলে (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) বা বেশি হলে (হাইপারগ্লাইসেমিয়া) খিঁচুনি হতে পারে।
- ইনসুলিনের ঘাটতি গুরুতর হলে ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস (DKA) হয়ে রোগীর খিঁচুনি দেখা দিতে পারে।
ক্যালসিয়াম ও প্যারাথাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্যহীনতা:
- রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা কমে গেলে খিঁচুনি হতে পারে।
- ক্যালসিয়ামের মাত্রা প্যারাথাইরয়েড হরমোন (PTH) ও ভিটামিন-ডি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
- প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যার কারণে রক্তে ক্যালসিয়াম কমে গেলে খিঁচুনির ঝুঁকি বাড়তে পারে।
থাইরয়েড হরমোনের প্রভাব:
- থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি থাকলে (Hypothyroidism) শিশুর স্নায়বিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে এবং খিঁচুনি দেখা দিতে পারে।
- আবার অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন থাকলে (Hyperthyroidism) স্নায়বিক উত্তেজনা বেড়ে গিয়ে খিঁচুনি হতে পারে।
করণীয়
শিশুর খিঁচুনি হলে দ্রুত পদক্ষেপ নিন
- শিশুকে নিরাপদ স্থানে চিত করে শুইয়ে দিন ও মাথা একপাশে কাত করে দিন।
- মুখে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।
- যদি খিঁচুনি ৫ মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়, তবে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান।
হরমোন ও রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে কারণ নির্ণয় করুন
- রক্তে সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, গ্লুকোজ, থাইরয়েড ও কর্টিসলের মাত্রা পরীক্ষা করুন।
- পিটুইটারি ও প্যানক্রিয়াস হরমোনের কার্যকারিতা নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করান।
প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করুন
- খিঁচুনির পেছনে যদি হরমোনজনিত কারণ থাকে, তবে এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট বা শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
- থাইরয়েড, ইনসুলিন বা অ্যাড্রেনাল হরমোনের ভারসাম্যহীনতা থাকলে সঠিক ওষুধ গ্রহণ করুন।
সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করুন
- শিশুর খাদ্যতালিকায় ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-ডি, আয়োডিন, স্বাস্থ্যকর প্রোটিন ও চর্বি সমৃদ্ধ খাবার রাখুন।
- হরমোনের ভারসাম্য রক্ষার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে পরিপূরক গ্রহণ করুন।
সতর্কতা
শিশুর খিঁচুনি হলে সাধারণত মস্তিষ্কের সংক্রমণ বা নিউরোলজিক্যাল সমস্যাকে দায়ী করা হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই হরমোনজনিত কারণও থাকতে পারে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময়যোগ্য।
শিশুর খিঁচুনি হলে হরমোনজনিত কারণগুলোকেও গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা উচিত। সঠিক পরীক্ষা ও চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যা শিশুর সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করবে।